শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য….

বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য….

উম্মে হাবিবা নুসরাত: গুরুজন হলেন আমাদের অমূল্য ধন এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের জ্ঞান পরিধি আমাদের থেকে অনেক বেশি। তাই আমাদের উচিত তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া। গুরুজনের মধ্যে রয়েছেন বাবা-মা ও পাড়ার বয়োবৃদ্ধরা। তবে এর মধ্যে বাবা-মায়ের গুরুত্ব অনন্য ও অগ্রগণ্য। তারা আমাদের অস্তিত্বে আসার মাধ্যম। সন্তানের জন্য বাবা-মা হলেন চোখের মণি, হৃদয়ের স্পন্দন। একজন মা গর্ভে ধারণ থেকে নিয়ে প্রতিটি পদে পদে সন্তানকে সযতেœ আগলে রাখেন বুকের মধ্যে। শত কষ্ট সহ্য করেও সন্তানকে তা বুঝতে দেন না। সন্তানের গায়ে বিন্দু পরিমাণ আঁচড়ও লাগতে দেন না কখনও। বাবাও নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে নেমে পড়েন আয়-উপার্জনের কাজে। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে পূরণ করেন সন্তানের আবদার। তাদের এ কষ্টের প্রতিদান কখনও দিতে পারবে না কোনো সন্তান।
মা-বাবাকে সম্মান দানের গুরুত্ব: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩)। এ আয়াতে আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে এর গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। সন্তান লালন-পালনে মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মা তাকে কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে, অনেক কষ্টে তাকে প্রসব করেছে আর তাকে গর্ভে ধারণ করা ও দুধ ছাড়ানোর সময় ৩০ মাস।’ (সূরা লোকমান : ১৪)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘ইবাদত কর আল্লাহর, শরিক করো না তাঁর সঙ্গে অপর কাউকে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও দাস-দাসির প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-অহংকারীকে।’ (সূরা নিসা : ৩৬)। অন্যত্র এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর।’ (সূরা নাহল : ৭৮)।
মা-বাবার মর্যাদা: হাদিসে আছে, এক সাহাবি রাসলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘সময়মতো নামাজ পড়া।’ তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এরপর কোনটি?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।’ তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এরপর কোনটি?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ (বোখারি : ১/৭৬)। একদিন এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে সবচেয়ে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ লোকটি জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ সে লোকটি আবারও প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তারপর তোমার বাবা।’ (বোখারি : ৫৯৭১)।
মা-বাবাকে সম্মান দানের ফজিলত: মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারে রয়েছে অফুরন্ত সওয়াব ও ফজিলত। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘বাবা-মায়ের সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবা-মায়ের অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত।’ (তিরমিজি : ২/১২)। অন্য হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের দায়িত্ব কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তারা উভয়ে তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ (ইবনে মাজাহ : ২৬০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘ওই লোক হতভাগ্য! ওই লোক হতভাগ্য! ওই লোক হতভাগ্য!’ জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কার ব্যাপারে একথা বললেন? নবী করিম (সা.) বললেন, ‘যে লোক বাবা-মায়ের একজন বা দুইজনকে তাদের বৃদ্ধ বয়সে পেল অথচ (তাদের খেদমত করে) জান্নাতে দাখিল হলো না, সে হতভাগ্য।’ (মুসলিম : ২৫৫১)।
মা-বাবাকে গালি দেওয়ার ভয়াবহতা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার বাবা-মাকে অভিসম্পাত করা। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষ তার বাবা-মাকে কীভাবে অভিশাপ করে? তিনি বললেন, ‘কোনো ব্যক্তি অপরের বাবা-মাকে গালি দেয়, ফলে সেও তার বাবা-মাকে গালি দেয়।’ (বোখারি : ৫৯৭৩)। বাবা-মায়ের শরিয়তবিরোধী আদেশ ছাড়া সবকিছু মানতে হবে : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যদি বাবা-মা তোমাকে চাপ দেয় আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলবে।’ (সূরা লোকমান : ৩১-১৫)। মুশরিক বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণ : হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার মুশরিক মা আমার কাছে এসেছে। আমি কি তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সদ্ব্যবহার কর।’ (বোখারি : ৩১৮৩)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমার মা ছিলেন মুশরিক। একদিন আমি তার কাছে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেন, যা আমার কাছে খুবই অপছন্দনীয় ছিল। তখন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলাম এবং তার হেদায়াতের জন্য দোয়া করতে বললাম। অতঃপর তিনি দোয়া করলেন। আমি বাড়িতে ফিরে দরজা নাড়লে ভেতর থেকে মা বলেন, তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। তারপর তিনি গোসল সেরে পোশাক পরে দরজা খুলে দেন এবং কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে তার ইসলাম ঘোষণা করেন।’ (মুসলিম : ২৪৯১)।
বাবা-মায়ের দোয়া: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিনটি দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। ১. বাবা-মায়ের দোয়া, ২. মুসাফিরের দোয়া, ৩. মজলুমের দোয়া।’ (আবু দাউদ : ১৫৩৬)। সুতরাং সন্তানের পক্ষে বা সন্তানের বিরুদ্ধে বাবা-মায়ের যে কোনো দোয়া নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। অতএব, এ ব্যাপারে বাবা-মা ও সন্তানদের সর্বদা সাবধান থাকতে হবে, যেন সন্তানের কোনো আচরণে বাবা-মায়ের অন্তর থেকে ‘উহ্’ শব্দ বেরিয়ে না আসে। অথবা সন্তানের প্রতি রুষ্ট হয়ে বাবা-মা যেন মনে বা মুখে কোনো বদদোয়া না করে বসেন।
বাবা-মা বৃদ্ধ হলে করণীয়: বাবা-মায়ের সেবাযতœ করা সন্তানের ওপর সর্বাবস্থায় ওয়াজিব। তবে মা-বাবা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তারা সন্তান থেকে সেবাযতেœর জন্য বেশি মুখিয়ে থাকেন। কেননা, বার্ধক্য হলো মানবজীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। বেঁচে থাকলে প্রত্যেকেই বৃদ্ধ হয়, এটা আল্লাহর অমোঘ বিধান। এ সময় তারা সেবাযতেœর মুখাপেক্ষী বেশি হন। তাই প্রত্যেক সন্তানের জন্য মা-বাবার সেবা আরও বেশি করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বাবা-মাকে বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের সঙ্গে করণীয় সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তাদের একজন বা উভয়ে বার্ধক্যে পৌঁছলে তাদের ‘উহ্’ শব্দটিও বলো না, তাদের ধমক দিও না, তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলো। তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে নম্রভাবে মাথানত করে দাও এবং বলো, হে প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো; যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (বনি ইসরাইল : ২৩/২৪)।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সন্তানের কর্তব্য: এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক সাহাবি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার এমন কোনো উপায় আছে কী, যা আমি অনুসরণ করতে পারি?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, চারটি উপায় আছে। তা হলো, ১. তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা, ২. তাদের কৃত ওয়াদা পূরণ করা, ৩. তাদের বন্ধু ও অন্তরঙ্গ ব্যক্তিদের সম্মান করা এবং ৪. তাদের মাধ্যমে তোমার সঙ্গে আত্মীয়তার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা অক্ষুণœ রাখা।’ (আবু দাউদ : ৫১৪২)।
বাবার বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা : আবদুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সদ্ব্যবহার হলো বাবার অবর্তমানে তার বন্ধুদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।’ (মুসলিম : ২৫৫)।
বাবা-মা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বড় নেয়ামত। এ পৃথিবীতে আমাদের অবাধ বিচরণে রয়েছে তাদের অগ্রণী অবদান। আর আল্লাহ তায়ালাও বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ করেছেন, তাদের সন্তুষ্ট রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বাবা-মায়ের সঠিক মর্যাদা উপলব্ধি করে তাদের সঠিক সম্মান ও মূল্যায়নের তৌফিক দান করুন।-আমিন!

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877